সম্প্রতি আফগানিস্তানের ঘটনাবলী
সম্প্রতি আফগানিস্তানের শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তন এসেছে। সাম্রাজ্যবাদী শক্তি আমেরিকা ও ন্যাটোর সেনাবাহিনী সে দেশের বুকের উপর চেপে বসেছিল ২০১১ সাল থেকে। তাদেরই মদতপুষ্ট সরকার দেশ চালাচ্ছিল। বর্তমানে সেই সেনা একের পর এক সরিয়ে নিচ্ছে। চুক্তি অনুযায়ী ৩১ শে আগস্টের মধ্যে সমস্ত সেনা সরিয়ে নিতে হবে। এই সুযোগে মৌলবাদী জঙ্গি সংগঠন তালিবান আফগানিস্থানে একের পর এক প্রদেশ দখল করছে, সে দেশের রাষ্ট্রপতির দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। দখল রাখতে তালিবানরা পথে-ঘাটে ঘুরছে। চলছে অরাজকতা।
সে দেশের সাধারণ জনগণ ভীত সন্ত্রস্ত। নিরাপত্তার কারণে দেশ ছাড়তে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। গ্রেট ব্রিটেন, ইরান, আমেরিকা, পাকিস্তান এমনকি ভারতেও আশ্রয়ের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। যারা সে দেশে কাজে গিয়েছিলেন তাঁরাও ফিরতে উদগ্রীব। আশ্রয় ছেড়ে বের হতে পারছেন না নিরাপত্তার কারণে। বিমানবন্দরেও আসতে পারছেন না অনেকে।
ইতিমধ্যে আফগানিস্তানের কিছু কিছু এলাকায় মানুষজন অল্প বিস্তর ঝুঁকি নিয়ে তালিবান শাহীর বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন। পথে নামছেন। আফগানিস্থানে মোট প্রদেশ ৩৪টি। বেশিরভাগ প্রদেশ তালিবানদের দখলে। তবে পঞ্চশীর প্রদেশ এখনও দখল নিতে পারে নি।
আফগানিস্তান অত্যন্ত পশ্চাত্পদ দেশ। অর্থনৈতিক জীবন অনুন্নত। পশ্চাত্পদ কৃষি ব্যবস্থা ও ক্ষুদ্র কুটির শিল্প ভিত্তিক জীবন। মৌলবাদী চিন্তা দ্বারা আচ্ছন্ন - যার নিয়ন্ত্রক ধর্মগুরু, মসজিদের ইমামরা। অসংখ্য উপজাতিতে বিভক্ত এবং এদের মধ্যে যুদ্ধ বিগ্রহ ছিল স্বাভাবিক ঘটনা।
কিন্তু অবস্থা চিরকাল এক থাকে না। আফগানিস্তানের অভ্যন্তরে ধীরে ধীরে পরিবর্তনের প্রবাহ শুরু হয়েছিল। গণতান্ত্রিক চেতনা, মূল্যবোধ, বিজ্ঞানভিত্তিক মানুসিতার প্রভাব বিস্তার করতে থাকে। ১৯৪৭ -এর শেষের দিকে আফগানিস্তানে এক দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। ১৯৪৭ সালের রাজতন্ত্রের অবসান হয় এবং মহম্মদ দাউদের নেতৃত্বে নতুন গণতান্ত্রিক সরকার গঠিত হয়। ব্রেজনেভ এর নেতৃত্বে সোভিয়েত ইউনিয়ন দাউদ সরকারকে সাহায্য করার উদ্যোগ গ্রহণ করে। তখন সামরিক ক্যু ঘটিয়ে তারিক্কী সরকার ক্ষমতায় বসানো হয়। দেড় বছর পর ১৯৭৯ সালে আবারও সামরিক করমু ঘটিয়ে ক্ষমতায় বসানো হয় হাফিজুল্লা আমিনকে। সোভিয়েতের এই আচরণের ফলে আফগানিস্তানের জাতীয়তাবাদী শক্তির সাথে তার সম্পর্ক চরম তিক্ততায় পর্যবসিত হয়। এই শক্তি তখন দক্ষিণপন্থী মৌলবাদী শক্তির সাথে ঐক্য করে। এরা আমিন সরকারকে কোণঠাসা করে ফেলে। এই অবস্থায় আমিন সরকারের আমন্ত্রণেও ও সরকারকে রক্ষা করতে সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৭৯ সালের ২৪শে ডিসেম্বর সামরিক বাহিনী ঢুকিয়ে দেয়। বাস্তবে দখলদার বাহিনীতে পরিণত হয়। তখন মুজাহিদীনেরা সোভিয়েতের বিরুদ্ধে গেরিলা হানা শুরু করে। এই অবস্থায় মধ্যপন্থী পিডিপিএ-এর এক নেতাকে প্রধানমন্ত্রী করা হয়। এই সরকার সোভিয়েতের কাছ থেকে আর্থিক ও সামরিক সহায়তা পেতে থাকে। অন্যদিকে মুজাহেদিনেরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, পাকিস্তান ও অন্যান্য রাষ্ট্র থেকে সাহায্য পেতে শুরু করে। ১৯৮৯ সালে সোভিয়েত সেনা প্রত্যাহারের পর আফগানিস্তানের গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। মুজাহেদিনেরা মার্কিন মদতে পিডিপিএ সরকারের বিরুদ্ধে আক্রমণ জোরদার করে। একদল মুজাহেদিন 'তালিবান' নামে একটি সংগঠন করে। এরা ১৯৯৬ সালে কাবুল দখল করে। পরে এদের সঙ্গে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে শুরু হয়। সন্ত্রাস দমনের নাম করে মার্কিন সেনাবাহিনী ২০০১ সালে আফগানিস্তানের দখল নেয়। তাদের তাবেদার সরকার চলে দীর্ঘ ২০ বছর। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে তৈরি হয় তীব্র ঘৃণা। এই ঘৃণা কে কেন্দ্র করে আবার একটু একটু শক্তি সঞ্চয় করে তালিবানেরা। এদেরকে মদত দিতে থাকে চীন, রাশিয়া, ইরান। এই অবস্থায় আমেরিকা গোপন চুক্তি করে আফগানিস্তান থেকে পাততাড়ি গুটাতে বাধ্য হয়। তালিবানরা পুনরায় ক্ষমতা দখল করতে শুরু করে। প্রায় সমস্ত আফগান প্রদেশ হলেও পঞ্চশীর প্রদেশ দখল করতে এখনও পারে নি। আতঙ্ক, অনিশ্চয়তা, নিরাপত্তা - এসব মিলিয়ে আফগানিস্থানে অস্থির পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
এই অবস্থায়, অদ্ভুত পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য আফগান বাসীদের নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে আসতে হবে। মৌলবাদী জঙ্গিবাদের এবং সাম্রাজ্যবাদী শক্তি আমেরিকাসহ সমস্ত বিদেশি সাম্রাজ্যবাদী শক্তির আগ্রাসনের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে। আর, বিশ্বের গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষ কে এই ষড়যন্ত্র ও অপচেষ্টার বিরুদ্ধে আফগান বাসীদের পাশে থাকতে হবে।